শিক্ষণ – শিখণে বক্তৃতা পদ্ধতি - SMH Amiri

সর্বশেষ লিখা

শিক্ষণ – শিখণে বক্তৃতা পদ্ধতি


প্রথমেই বলতে হয়, শিক্ষণ – শিখণে অংশগ্রহণমূলক পদ্ধতিই হচ্ছে বর্তমান সময়ের সর্বাধিক গ্রহণযোগ্য একটি পদ্ধতি। অংশগ্রহণমূলক পদ্ধতি বিজ্ঞানসম্মত ও সর্বাধুনিক একটি শিক্ষ-শিখণ পদ্ধতি। তবে সনাতন ধর্মী বা পুরাতন একটি শিক্ষণ- শিখণ পদ্ধতি হলো বক্তৃতা পদ্ধতি। এ পদ্ধতির কিছু বিস্তারিত আলোচনা করব আজ।

বক্তৃতা পদ্ধতি এমন একটি পদ্ধতি যার ব্যবহারে শিক্ষককে মৌখিক বিবৃতির সাহায্যে শিক্ষণীয় বিষয়বস্তু শিক্ষর্থীর কাছে উপস্থাপন করতে হয়। এ পদ্ধতিতে শিক্ষার্থীর অংশগ্রহনের সুযোগ অত্যন্ত সীমিত। শিক্ষক কেন্দ্রিক এ পদ্ধতি শিক্ষকের পাঠ উপস্থাপরনের পারদর্শিতার উপর নির্ভরশীল। অর্থাৎ শিক্ষকের বক্তৃতাদানের পারদর্শিতা তথা বাগ্মিতা, গুণ, বক্তৃতাদানের কৌশল, বিষয়বস্তুকে শিক্ষার্থীর হৃদয়াগ্রহী করে তোলার ক্ষমতা, শিক্ষর্থীর বয়স, মেধা, আগ্রহ, বোধগম্যতা ইত্যাদির পরিপ্রেক্ষিতে বিষয়বস্তুকে আকর্ষণীয়ভাবে উপস্থাপনের দক্ষতার ওপরে শিক্ষাদানের সার্থকতা অনেকাংশে নির্ভর করে।

বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ নেলসন এল. বোসিং বলেছেন, ÒThe Lecture is a Method of exposition ”। অর্থাৎ বক্তৃতা হচ্ছে ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের পদ্ধতি।

একটি বিখ্যাত শিক্ষা বিষয়ক ওয়েব সাইটে (712educators.about.com) লিখা আছে যে,“ Lecture is when an instructor is the central focus of information transfer. Typically, an instructor will stand before a class and present information for the students to learn. Usually, very little exchange occurs between the instructor and the students during a lecture. ”


বিখ্যাত দার্শনিক টমাস হেলার বলেছেন যে, “ It is oldest teaching method given by philosophy of idealism. As used in education, the lecture method refers to the teaching procedure involved in clarification or explanation of the students of some major idea. This method lays emphasis on the penetration of contents. Teacher is more active and students are passive but he also uses question answers to keep them attentive in the class. It is used to motivate, clarify, expand and review the information. By changing Ms Voice, by impersonating characters, by shifting his posing, by using simple devices, a teacher can deliver lessons effectively, while delivering his lecture; a teacher can indicate by her facial expressions, gestures and tones the exact slode of meaning that he wishes to convey. Thus we can say that when teacher takes the help of a lengthy-short explanation in order to clarify his ideas or some fact that explanation is termed as lecture or lecture method and after briefing about lecture method. ”

বক্তৃতা পদ্ধতির উদ্ভব:

মধ্যযুগে ইউরোপে বিশ্ববিদ্যালয় সৃষ্টির সাথে সাথে এ পদ্ধতির উদ্ভব হয়। গ্রীক পন্ডিতদের মতবাদ শিক্ষার্থীদের মাঝে পৌছানোর জন্যে পাণ্ডুলিপির বিষয়বস্তু বক্তৃতার মাধ্যমে পরিবেশিত হত। অষ্টাদশ শতাব্দীর বৈজ্ঞানিক যুক্তিবাদ এই পদ্ধতিকে সুদৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত করে। জার্মান বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এই পদ্ধতি বিজ্ঞান সম্মত ভিত্তিতে প্রবর্তিত হয়।

বাংলাদেশের যে কারণে বক্তৃতা পদ্ধতি ব্যবহৃত:

নির্দিষ্ট সময়ে পাঠ শেষ করার তাগিদটাই এ ক্ষেত্রে প্রবল। শিক্ষার্থীর সামর্থ, আগ্রহ, বয়স, মেধা, ধারণক্ষমতার প্রয়োজনীয়তা খুব একটা বিবেচনায় থাকে না। সামপ্রতিককালে শিক্ষার্থীকেন্দ্রিক শিখন প্রক্রিয়ায় শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহন নিশ্চিত করতে উদ্ভাবিত হয়েছে বহু নতুন নতুন পাঠদান পদ্ধতি। কিন্তু আমাদের দেশ বাংলাদেশের তৃতীয় বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশ, এ দেশের শিক্ষাঙ্গনে এ সবের সার্থক রূপায়ণ প্রায় অনুপস্থিত। অধিক শিক্ষার্থী সংখ্যা, সীমিত সময়, দক্ষতা সম্পন্ন শিক্ষকের অভাব, সক্রিয়তা ও আনন্দের মধ্যে রেখে পাঠ উপস্থাপনে দৃষ্টিভঙ্গির অভার ইত্যাদি নানাবিধ কারণে অধিকাংশ শিক্ষকই বক্তৃতা পদ্ধতি ব্যবহার করে থাকেন।

একটি সনাতন পদ্ধতি:

শ্রেণীকক্ষে পাঠদানের ক্ষেত্রে একটি সনাতন পদ্ধতি হল বক্তৃতা পদ্ধতি। এর মাধ্যমে শিক্ষক কেবলমাত্র নিজের আয়ত্ত করা বিষয়গুলো শ্রেনীকক্ষে কথা বা বক্তৃতার মাধ্যমে পরিবেশন করেন। উচ্চ শ্রেণীতে এ পদ্ধতিটি কার্যকরী হলেও নিম্নশ্রেণীতে তা কার্যকরী নয়। কারণ শিশুরা এ পদ্ধতিতে বিষয়বস্তু সহজে আয়ত্ত করতে পারে না। সুতরাং এ পদ্ধতিতে সীমাবদ্ধতা আছে। বক্তৃতা পদ্ধতিতে শিক্ষক শুধু বলে যান শিক্ষার্থীরা শুণে এবং লিখে নেয়।

বক্তৃতা পদ্ধতির বৈশিষ্ট্য:

শ্রেণীকক্ষে পাঠদান পদ্ধতিতে বক্তৃতা পদ্ধতির কিছু বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান। যে বৈশিষ্ট্য সমূহ বক্তৃতা পদ্ধতিকে চিহ্নিত করতে সহায়তা করে। নিম্নে তা আলোচনা করা হল।
• বক্তৃতা পদ্ধতিতে শিক্ষক হচ্ছে মূল বক্তা আর শিক্ষার্থী হচ্ছে শ্রোতা
• সুষ্ঠুভাবে পাঠ উপস্থাপণের জন্য পূর্ব প্রস্তুতি নিয়ে শিক্ষককে শ্রেণীকক্ষে আসতে হয় না।
• বক্তৃতা পদ্ধতি স্বার্থক প্রয়োগের জন্য শিক্ষকের যোগ্যতা, দক্ষতা ও বিষয়বস্তু সম্পর্কে জ্ঞান থাকা প্রয়োজন।
• শিক্ষকের কন্ঠস্বর, প্রকাশভঙ্গি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
• মূল বিষয়ের সাথে বক্তৃতা অবশ্যই সামঞ্জস্যপূর্ণ প্রয়োজন।
• বক্তৃতা পদ্ধতি একটি শিক্ষক নির্ভর পদ্ধতি। তাই শিক্ষককে শিক্ষার্থীরা মনযোগ আকর্ষণ ও মনযোগ অক্ষুন্ন রাখার বিষয়ে লক্ষ্য রাখতে হবে।
• বক্তৃতা পদ্ধতি অন্য যে কোন পদ্ধতি শ্রেণীকক্ষে সার্থক প্রয়োগের জন্য ব্যবহার করতে হয়।
• বক্তৃতা পদ্ধতি অনেক পুরানো পাঠদান প্রক্রিয়া।
• অধিক সংখ্যক শিক্ষার্থীর জন্য বক্তৃতা পদ্ধতি প্রযোজ্য।
• কোনরূপ যন্ত্রপাতির প্রয়োজন নেই।
• সময় এবং খরচ উভয়ই কম হয়।
• শিক্ষকের কর্ম তৎপরতা বেশী থাকে।
• স্বল্প সময়ে অনের বিষয়বস্তু পাঠদান করা যায়।
• বক্তৃতা পদ্ধতিতে শিক্ষকের যোগ্যতাই হলো মূল পুঁজি।
• শিক্ষকের উপস্থাপণ কৌশল ভাল হওয়া আবশ্যক।
• শিক্ষার্থীদের মনে একঘেয়েমী, অবসাদ, ক্লান্তি ও বিরক্তি আসে।
• অনেক শিক্ষক স্বভাবগত কারণেই বেশী কথা বলে থাকেন। প্রয়োজনে সঙ্গতিপূর্ণ উপমা, উদাহরণ ও গল্প উপস্থাপন করতে পারেন।
• বিষয়বস্তুর প্রতি অনুরাগ সৃষ্টির লক্ষ্যে শিক্ষককে মাঝে মাঝে অভিব্যক্তির বৈচিত্র সৃষ্টি করতে হয়।
• শিক্ষার্থীদের মানসিক প্রস্তুতির জন্য শিক্ষককে কল্পনাশক্তি ও বক্তৃতাকে রসাত্মক করে তুলতে হয়।
• বক্তৃতা পদ্ধতি সকল নবী-রাসুল, ধর্মীয় গুরু এবং পুরোহিতদের অনুসৃত পদ্ধতি।
• শিক্ষকের যথেষ্ঠ আত্মবিশ্বাস থাকে।
• শিক্ষার্থীদের অনুরাগ ও বুদ্ধি বিবেচনায় রেখে বিষয়বস্তু উপস্থাপন করতে হয়।
• সহজবোধ্য উপস্থাপন করতে না পারলে বিষয় বস্তুটি আকর্ষণীয় হয় না।
• শিক্ষার্থীর মনযোগ সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যায় না।
• বক্তৃতা পদ্ধতি প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে ফলপ্রসূ না হলেও উচ্চশিক্ষায় তা উপযোগী।
• শিক্ষার্থীদের মধ্যে উচ্চাকাঙ্খা ও আগ্রহগ সৃষ্টি করা যায়।

বক্তৃতা পদ্ধতির সুবিধা সমূহ:

শিক্ষণে বক্তৃতা পদ্ধতি ব্যবহারে অনেক সুবিধা রয়েছে। নিম্নে এ সকল সুবিধাসমূহ আলোচনা করা হলো।
• নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে কার্য সম্পাদন করা যায়।
• পাঠের বিষয়ব সুষ্ঠুভাবে উপস্থাপন করা সম্ভব হয়।
• অধিক সংখ্যক শিক্ষার্থীকে একসাথে পাঠদান করা যায়।
• অল্প সময়ে অধিত তথ্য পরিবেশন করা।
• পাঠদানের ধারাবাহিকতা রক্ষা হয়।
• বর্ণনামূলক বিষয়ের ক্ষেত্রে উপযোগী।
• শ্রেণীকক্ষের বাইরেও এ পদ্ধতির প্রয়োগ সম্ভব।
• বেশী উপকরণ ব্যবহার প্রয়োজন হয় না।
• কম ব্যয় সাপেক্ষ।
• সঠিক সময়ে পাঠ শেষ করা যায়।
• শিক্ষার্থীদেও শ্রবণ দক্ষতা বৃদ্ধি পায়।
• সুবিধামতো ভাষা ও উপমা ব্যবহার করা যায়।
• শিক্ষার্থীদের পূর্বজ্ঞান জেনে নতুন বিষয় উপস্থাপন করা যায়।
• শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন বিষয় মুখস্ত করানোর ক্ষেত্রে এটি উপযোগী।
• শিক্ষকের ততোটা দ্‌ষতা ছাড়াই শ্রেণীর পাঠ পরিচালনা করতে পারেন।
• এটি গতানুগতিক একটি ¯^vfvweK শিক্ষাদান পদ্ধতি।
• শিক্ষার সকল স্তরেই বক্তৃতা পদ্ধতি ব্যবহার করা যায়।
• বয়স্ক শিক্ষার্থীদের শিক্ষারম্ভ করা সহজ হয়।
• প্রশ্নোত্তরের মাধ্যমে শ্যেণীকক্ষের সাধারণ সমস্যা সমূহ সম্পর্কে অবিহিত হওয়া যায়।
• শিক্ষকের কাজ অনেকটাই সহজ-সরল হয়।
• শিক্ষার্থীদের নানাভাবে উদ্দীপ্ত করে গড়ে তোলে।
• শিক্ষার্থীদের শুণে দ্রুত নোট করার দক্ষতা বাড়ে।
• ক্রমান্বয়ে শিক্ষার্থীও ভাল বক্তায় পরিণত হয়।

বক্তৃতা পদ্ধতির অসুবিধা সমূহ:

শিক্ষণে বক্তৃতা পদ্ধতি ব্যবহারে অনেক অসুবিধা রয়েছে। নিম্নে এ সকল অসুবিধাসমূহ আলোচনা করা হলো।
• বক্তৃতা পদ্ধতি মনোবিজ্ঞান সম্মত নয়।
• শিক্ষার্থীরা নিস্ক্রিয় হয়ে পড়ে।
• শিক্ষার্থীর মেধার বিকাশ ঘটে না।
• পাঠে একঘেয়েমী চলে আসে।
• শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর মধ্যে সুষ্ঠু সম্পর্ক গড়ে উঠেনা।
• শিখণ ক্ষণস্থায়ী হয়।
• বক্তৃতা পদ্ধতি একমূখী, শিক্ষক স্বর্বস্ব ।
• শিক্ষার্থীরা শিক্ষকের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে।
• পাঠের লক্ষ্য অর্জনে অনেক ক্ষেত্রেই ব্যর্থ হয়।
• শিক্ষার্থীরা হাতে কলমে কাজ করার সুযোগ পায় না।
• মেধাসম্পন্ন শিক্ষার্থীরা ক্ষতিগ্রস্তহয়।
• পাঠের অনুকূল পরিবেশ বজায় রাখা কঠিন হয়।
• শিখন সঞ্চালন সম্ভব হয়না।
• শিক্ষকের উদ্ভাবনী শক্তি স্তিমিত হয়ে পড়ে।
• শিক্ষার্থীদের জ্ঞান যাচাই করার সুযোগ নেই।
• শিক্ষার্থীদের মুক্ত চিন্তার পরিস্ফুটন ঘটে না।
• শিক্ষার্থীদের স্বতস্ফূর্ত মনোযোগ আকর্ষণ হয় না।
• শিক্ষার্থীদের ব্যবহারিক দক্ষতা অর্জিত হয় না।
• তত্ত্বীয় বিষয়বস্তু পরিস্ফুটিত হয় না।
• শিক্ষার্থীর জ্ঞানের প্রসার ঘটে না।
• দলীয় কাজ করোনো সম্ভব হয় না।
• Learning by doing সম্ভব হয় না।

পরিশেষে, শিক্ষা একটি গতিশীল ও জীবনব্যাপী প্রক্রিয়া। জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত এর পরিধি বিস্তৃত। সুতরাং কাজ হচ্ছে শিক্ষার্থীকে দক্ষ করে তোলা। শিক্ষার্থীদেরকে যে কোন বিষয়ে দক্ষ করে তুলতে হলে তার জন্য প্রয়োজন উপযুক্ত শিক্ষা এবং এই শিক্ষণ -শিখণ কার্যাবলী পরিচালনার জন্য বিভিন্ন সময় বিভিন্ন পদ্ধতি অনুসরণ করতে হয়। পূর্বে শিক্ষা ব্যবস্থা ছিল শিক্ষককেন্দ্রিক। শিক্ষককে কেন্দ্র করে পাঠের বিষয়বস্তু পরিচালিত হত। যে কোন বিষয় শিক্ষণে বক্তৃতা পদ্ধতি হচ্ছে একটি সনাতন পদ্ধতি। শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহন বক্তৃতা পদ্ধতিতে নেই বল্লেই চলে।

(বিভিন্ন বই, জার্নাল, ব্লগ ও ওয়বে সাইট এর সাহায্যে)

No comments:

Post a Comment

Pages